সুন্দর শৈশব ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এই দুইয়ের মাঝে এক বড় বাধা বাল্যবিয়ে। বিশ্বের অনেক দেশেই এই সামাজিক ব্যাধি লক্ষ্য করা যায়। মেয়েদের পাশাপাশি ছেলেরাও বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে। বিশ্বে প্রতি ৩০ জন ছেলেশিশুর একজন বাল্যবিয়ের শিকার হয়।
বাল্যবিবাহ বলতে সমাজে শুধুমাত্র অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে শিশুদের বিয়েকেই চিহ্নিত করা হয়। ছেলে শিশুরাও যে এর ভিড়ে বাল্যবিয়েতে জড়িয়ে পড়তে পারে সে ব্যাপারে খুব একটা গুরুত্ব দিতে দেখা যায় না।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বাল্যবিয়ের মূল কারণ বলা হয় দারিদ্র্যকে। মেয়ে শিশুর দ্রুত বিয়ে দিয়ে তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেতেই মূলত বাল্যবিয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনা যেহেতু একটা ছেলে শিশুর সঙ্গে ঘটা সম্ভব নয় তাই বাংলাদেশে বা অন্য কোথাও যে ছেলে শিশু বাল্যবিয়ের শিকার হতে পারে তা কোনোভাবেই গুরুত্ব পায় না। কিন্তু বাস্তবতা আসলে তা নয়।
২০১৯ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফ জানায়, সারা বিশ্বে আনুমানিক ১১ কোটি ৫০ লক্ষ ছেলে শিশুর বাল্যকালেই বিয়ে হয়ে গিয়েছে। প্রতিবেদনটির তথ্য, প্রতি ৩০ জন ছেলেশিশুর একজন বাল্যবিয়ের শিকার হয়।
ছেলে শিশুদের বাল্যবিয়ের হার সবচেয়ে বেশি আফ্রিকান দেশগুলোতে, কারণ সেখানে অল্প বয়সেই বিয়ে করার প্রথা রয়েছে। বাল্যবিয়ের ঝুঁকি না চিন্তা করেই সেসব দেশে ছেলে ও মেয়ে উভয়েই বাল্যবিয়ের শিকার হয় এবং খুবই অল্প বয়সে তাদের কাঁধে সংসারের দায়িত্বের বোঝা চলে আসে।
বাংলাদেশে সাধারণত এ ধরনের প্রথার কারণেই ছেলেদের বাল্যবিয়ে হয়ে থাকে। তবে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক পরিবারেই মেয়ে শিশুদের মতো ছেলেদেরও অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় বিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটে। আবার মৃত্যুশয্যায় থাকা দাদা-দাদী, নানা-নানীর শেষ ইচ্ছা পূরণের জন্য অল্প বয়সে ছেলেদের বিয়ে দিয়ে দেয়ার কথাও শোনা যায়।
গ্রামাঞ্চলেও কোনো বিশেষ কারণ ছাড়াই অনেকসময় ছেলেশিশুদের ১৬-১৭ বছর বয়সে বিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটে। অল্প শিক্ষিত বা নিরক্ষর অভিভাবক বিয়ের জন্য এ বয়সকেই উপযুক্ত মনে করে। মেয়েদের পাশাপাশি ছেলেরাও এই ধারণার কারণে বাল্যবিয়ের শিকার হয়।
এছাড়াও নিম্নবিত্ত পরিবারের কর্মজীবী ছেলেশিশুরাও অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায়ই বাল্যবিয়ের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। কাজ করাকেই তারা বিয়ের বয়স হিসেবে ধরে নেয়। ওই পরিবারগুলোতে দেখা যায় বাল্যবিয়ের নেতিবাচক পরিণতি না ভেবেই কিশোর বয়সেই ছেলেদেরও বিয়ে দেয়া হয়। কর্মজীবী ১৬-১৭ বছর বয়সের একজন ছেলেশিশুর বিয়ে যে বাল্যবিয়ে এবং এর প্রভাব সমাজে কেমন হতে পারে তা নিম্নবিত্ত পরিবারে প্রায়ই গুরুত্ব পায় না।
ছেলেদের বাল্যবিয়ে হলে ক্ষতি কী?
ছেলেশিশুদের বাল্যবিয়েও সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শিশু অবস্থায় বিবাহিত একজন কিশোরকে অপরিণত বয়সেই প্রাপ্তবয়স্কের মতো দায়িত্ব নিতে বাধ্য হতে হয়, যার জন্য তারা মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে না।
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক ন্যাশনাল পাব্লিক রেডিওর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত নেপালের মানসিক স্বাস্থ্য এবং কাউন্সেলিং কেন্দ্রের টেকনিক্যাল ডিরেক্টরের বক্তব্য থেকে জানা যায়, বাল্যবিয়ের শিকার মেয়েশিশুর তুলনায় ছেলেশিশুরা মানসিকভাবে বেশি অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়ে এমনকি তা ভয়ানক পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যায়। অল্প বয়সেই সংসারের দায়িত্ব কাঁধে পাওয়া একজন কিশোর মানসিকভাবে কতটা ভেঙে পড়তে পারে তা এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, বাল্যবিয়ের শিকার ছেলেদের পাশাপাশি তার সন্তানেরাও এই একই ঘটনার কারণেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কারণ বাল্যকালে বিবাহিত একজন কিশোর কখনোই সন্তানের কাছে আদর্শ বাবা হয়ে উঠতে পারে না। শিশুর বেড়ে উঠতে যে সাহায্য প্রয়োজন তা কিশোর বাবা পূরণ করতে পারে না কারণ তার নিজের বাল্যকালই সম্পূর্ণ নয়।
তাসনুভা মেহজাবীন (১৫), খুলনা