উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে নিম্নবিত্ত কোনো অবস্থানে কোথাও নিরাপদে নেই আমাদের শিশু। বিদ্যালয় কিংবা নিজ পরিবার, শিশুরা যেন নিরাপদ নেই কোন স্তরেই।
প্রতিদিন খবরের কাগজ আর টেলিভিশনের পর্দা জুড়ে থাকে শিশু নির্যাতন বা পাশবিক নির্যাতনের খবর, যা আমাদের জানায় আমাদের আত্মায় বাসা বেঁধেছে এক গুরুতর অসুখ। এমনকি পাশবিক নির্যাতনের শিকারের তালিকায় এমন মেয়ে শিশু আছে যাদের বয়স দুই পেরোয়নি।
ধর্ষকদের তালিকায় আছেন শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, আপন চাচা এমনকি জন্মদাতাও। তাহলে শিশুরা নিরাপদ কোথায়?
একটা সময় নিজের পরিবার একটি শিশুর জন্য সবচেয়ে নিরাপদ ছিল। কিন্তু বর্তমানে এ ভিত অনেকটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। খবরে পড়লাম এক বাবা তার প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে নিজের সন্তানকে হত্যা করেছেন।
সামাজিক গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখেছি ১২ বছরের শিশুকে চুরির অভিযোগে মধ্যযুগীয় কায়দায় গাছের সাথে বেঁধে নির্যাতন করা হয়েছে। অন্যদিকে রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলায় ১৩ বছরের মেয়েকে পাশবিক নির্যাতন করার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে শিশুটির জন্মদাতাকে। এমন অহরোহ ঘটনা আমাদের চারপাশে ঘটেই চলছে।
গত পাঁচ বছরে সারাদেশে হত্যার শিকার হয়েছে ১৭ হাজারের বেশি মানুষ, এর মধ্যে শিশুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। শিশু নির্যাতন দিন দিন মারাত্মক রূপ ধারণ করছে।
বিগত বছরগুলোর চেয়ে বাংলাদেশে শিশুর প্রতি সহিংসতা উদ্বেগজনকহারে বেড়েছে। শিশুর নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি এখন আমাদের দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
‘চাইল্ড রাইটস অ্যাডভোকেসি কোয়ালিশন ইন বাংলাদেশ’ নামের একটি সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অগাস্ট মাস পর্যন্ত তিন হাজার ছয়শত ৫৩টি শিশু বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছে চারশত ৫৭টি শিশু। আগের বছরে প্রতি মাসে শিশু নির্যাতনের সংখ্যা ছিল তিশত ৮১টি।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত পাশকিব নির্যাতনের শিকার হয়েছে প্রায় সাতশ শিশু। এছাড়া পাশবিক নির্যাতনের চেষ্টা করা হয়েছে ১০৪ জন শিশুকে। এছাড়া ১৬১ জন শিশুকে যৌন হয়রানি ও ২৮৫ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এ সময়ে আত্মহত্যা করেছে ১৩৩ জন। অপহরণ করা হয়েছে ১৪৫ শিশুকে। নিখোঁজ হয়েছে ১০৪ জন।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর এ নয় মাসে পাশবিক নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে ২৯ শিশুকে। অপহরণের পর হত্যার শিকার হয়েছে ২৩ শিশু। এ ছাড়া প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোসহ বিভিন্ন কারণে জন্মদাতা কিংবা জন্মদাত্রীর হাতেই নির্মম ও বর্বোরচিত কায়দায় হত্যার শিকার হয়েছে ২৮টি শিশু।
এছাড়া আইন ও সালিশ কেন্দ্রে পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত পাঁচ বছরে পাশবিক নির্যাতনের শিকার নারীদের মধ্যে ৯০ শতাংশই শিশু ও কিশোরী। এ সময়ে সাত বছর থেকে থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশু ও কিশোরীরাই বেশি নির্যাতনের শিকার।
শিশুর প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন কমছে না বাংলাদেশে। বরং বেড়েই চলেছে। সহিংসতার শিকার এই শিশুদের বড় অংশই নিম্নবিত্ত পরিবারের অথবা গৃহকর্মী। সহিংসতা, যৌন নিপীড়ন, শিশু শ্রম, বাল্যবিয়ে এবং মানসিকভাবে হয়রানি অহরহই ঘটছে।
ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে শারীরিক ও যৌন সহিংসতার শিকার হচ্ছে ৬১ শতাংশ শিশু। আর ৬৭ শতাংশ শিশু বাল্যবিয়ে ও ৬১ শতাংশ শিশু রয়েছে শিশুশ্রমের সঙ্গে।
আমাদের দেশের আইনে এখন ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু। নয় বছর বয়স পর্যন্ত শিশু কোনো অপরাধই করতে পারে না। আমাদের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে শিশুদের বড় একটি অংশকে কাজ করতে হয়। বলা বাহুল্য, শিশুরা দুর্বল বলে অপরাধীদের সহজ লক্ষ্যে পরিণত হয় তারা। দুর্নীতির বিস্তার, সমাজের ও পরিবারের নৈতিক বোধগুলো হারিয়ে যাওয়া, পণ্যসংস্কৃতির বলি হয়ে শুদ্ধতাকেও বলি দেওয়া এর কারণ।
দেশে শিশুর সুরক্ষা আইন এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। অন্যদিকে শিশুদের জন্য যেসব সেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে সেগুলোতে মান ও সমতার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। নৈতিকতা, সুনীতি চর্চা, শুদ্ধাচার এবং নান্দনিক বোধের বিস্তার, পাশাপাশি স্কুল-মাদ্রাসা-কোচিং কেন্দ্রগুলোকে কঠোর নজরদারিতে রাখতে হবে, শিক্ষক নিয়োগে নৈতিকতাটি একটি আবশ্যকীয় মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আর সংষ্কৃতির প্রসারে বিশেষ জোর দিতে হবে। শিশু নির্যাতন বন্ধ করতে হলে আমাদের শিশুদের সামাজিক নিরাপত্তা সর্বপ্রথম নিশ্চিত করতে হবে। আর নয় নির্যাতন, বাড়াতে হবে সামাজিক নিরাপত্তা।
ফাহিম আহম্মেদ রিয়াদ (১৭), বগুড়া