প্রতি মাসেই মেয়েদের শরীর গর্ভধারণের জন্য প্রস্তুত হয়। গর্ভধারণের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান না পেলে ডিম্বাণু রক্তের মাধ্যমে শরীর থেকে বের হয়ে আসে, যাকে আমরা পিরিয়ড হিসেবে জানি।
এই অতি স্বাভাবিক ঘটনাকে গ্রামীণ কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে 'আড়চোখে' দেখা হয়, যেটা অনভিজ্ঞ কিশোরীদের মনে ভীতিসঞ্চার করে।
ভয় ও চক্ষুলজ্জায় কিশোরীরা পরিবারের পরামর্শ চাইতে পারে না। স্যানিটারি ন্যাপকিনের বদলে অস্বাস্থ্যকর কাপড় ব্যবহার করে, যা ক্যান্সারের মতো মরণঘাতী রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী।
২০১৪ সালের এক জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৮৫ ভাগ নারী পিরিয়ডের সময় স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করে না। সর্বসাকুল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারকারী নারীর সংখ্যা ১৫ শতাংশের মতো।
এর অন্যতম কারণ চক্ষুলজ্জা ও ভয় তো বটেই তারসঙ্গে আছে স্যানিটারি ন্যাপকিনের উচ্চমূল্য। রকমভেদে স্যানিটারি ন্যাপকিনের দাম ১২০-১৬০ টাকা, যা সচ্ছল পরিবারেরর কাছে স্বাভাবিক হলেও অসচ্ছল পরিবারের কাছে বেশ অতিরিক্ত।
এটি মেয়েদের অতি প্রয়োজনীয় পণ্য হলেও এটাকে বিলাসী পণ্য ধরে 'পিংক ট্যাক্স' আরোপ করা হয়েছে। এখনো আমাদের সমাজ এটাকে বিলাসদ্রব্য মনে করে।
স্যানিটারি প্যাড উৎপাদনকারী এক প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, স্যানিটারি প্যাড তৈরির কাঁচামালের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। এছাড়া রয়েছে ২৫ শতাংশ কাস্টমস ডিউটি, পাঁচ শতাংশ অগ্রিম আয়কর, তিন শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি ও ভার শতাংশ এডিটি। ভ্যাট মওকুফ করা হলে প্রতি প্যাকেট স্যানিটারি ন্যাপকিনের দাম ৪০-৪৫ শতাংশ কমানো সম্ভব।
এক জরিপ বলছে, শহরাঞ্চলে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবহার ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ হলেও সামগ্রিকভাবে সেই হার মাত্র ১২ থেকে ১৫ শতাংশ।
পিরিয়ড চলাকালে অব্যবস্থাপনা মেয়েদের শিক্ষাক্ষেত্রে ও নারীদের কর্মক্ষেত্রে অনেকটা পিছিয়ে রাখছে, যা ক্ষমতায়নে প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন বেসলাইন সার্ভের তথ্য বলছে, ৪১ শতাংশ কিশোরী পিরিয়ডের সময় স্কুল-কলেজে অনুপস্থিত থাকে।
অতিরিক্ত ভ্যাট আরোপের ফলে স্যানিটারি ন্যাপকিনের মূল্য পৌঁছে গেছে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ধরা-ছোয়ার বাইরে। বিবিসির এক জরিপ বলছে, পিরিয়ডের সময় অস্বাস্থ্যকর কাপড় ব্যবহারের ফলে প্রতি বছর দেশের বারো হাজার নারী জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়।
বাংলাদেশে যেখানে এক পিস স্যানিটারি ন্যাপকিনের দাম গড়ে ১৫-২৫ টাকা হয়, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে এর দাম গড়ে ২-৩ টাকা। পশ্চিমবঙ্গের প্রাদেশিক সরকার নারীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্যানিটারি ন্যাপকিনের ওপর ভ্যাট মওকুফ করার পাশাপাশি সরকারি তহবিল থেকে ভর্তুকি প্রদান করে। যার ফলে অতি স্বল্পমূল্যে নারীরা স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে পারে।
খুব সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ষষ্ঠ ইন্দ্রীয়' নামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নগরীর জিরো পয়েন্ট এলাকায় স্যানিটারি ন্যাপকিনের ওপর ভ্যাট মওকুফ করার দাবিতে মানববন্ধন করে। সংগঠনটির সদস্য ছাড়াও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই নারী। তাদের স্বাস্থ্যসুরক্ষায় আমাদের সচেতন থাকতে হবে। অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে অসুরক্ষিত রেখে দেশের প্রকৃত উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়।
মুহাম্মাদ শরিফুজ্জামান বাপ্পি (১৫), রাজশাহী